২০১৯ এ সংসদ অধিবেশনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য রাস্ট্রপতির দেয়া এক বিবৃতি থেকে আমরা জানতে পেরেছি, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী অবশেষে ২৪টি নতুন বেসিক ট্রেইনার এয়ারক্রাফট কেনার মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বৈমানিকদের প্রথম প্রেমিকা পিটি-৬ বিমানকে রিপ্লেস করার কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৪টি বেসিক মিলিটারি ট্রেইনার বিমান বেশ আলোচিত।সুইজারল্যান্ডের পিসি-২১, অস্ট্রিয়ান ডায়ামন্ড ৪০, তুরস্কের হুরকুস এবং কোরিয়ার কেটি-১। সুপার টুকেনো ৩১৪ এর দাপট সম্ভবত শেষ!
বাংলাদেশ বিমান বাহিনি যেহেতু ট্যানডেম ককপিট ( সাইকেলের মত সামনাসামনি, গাড়ির মত পাশাপাশি নয়) প্রেফার করে, সেহেতু ডায়ামন্ড ৪০ এর সম্ভাবনা নেই। পিসি-২১ এর মত বিমান একেবারে রুকি বৈমানিকদের হাতে তুলে দেবার মত বিলাসিতা হয়ত আমাদের মত অর্থনীতির দেশের এখনো হয়নি।
বেশ কিছু বছর ধরেই, তুরস্ক নানাভাবে আমাদের সামরিক বাজারে প্রবেশ করতে চাইছে। আমরাও ক্রমে চায়না ,রাশিয়া থেকে সরে ইউরোপিয়ান/ন্যাটো স্ট্যান্ডার্ডের জিনিস কিনতে চাচ্ছি।এখন পর্যন্ত ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় তুরস্কের বিভিন্ন উচ্চমানের সামরিক পণ্যের একটি প্রদর্শনী হবার কথা রয়েছে। অন্যদিকে, বেশ উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল সহ দক্ষিন কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানী, তথ্যপ্রযুক্তি ও সামরিক খাতে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে ঢাকা ঘুরে গিয়েছেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তুরস্কের হুরকুস কিংবা কোরিয়ান কেটি-১ বিমানই হবে আমাদের বৈমানিকদের নতুন প্রথম প্রেমিকা!
দেখতে একই মনে হলেও আসলে, দুটি একই মানের বিমান নয়। সহজ অর্থে বলা যায়,দুটি ভিন্ন জেনারেশন বা সময়ের বিমান। সামরিক বিমান কেনার সময় কিছু বিষয় বিবেচনা করা হয়,যেমনঃ
- মিশন রিকোয়ারমেন্ট, ইন্টারমেডিয়েট হায়ার কোর্স/অন্যক্ষেত্রেও ব্যবহারের সুযোগ
- বিমানে ব্যবহৃত এভিওনিক্স
- কেনার খরচ, যন্ত্রাংশের খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, মাথাপিছু ঘন্টা হিসেবে প্রশিক্ষণ খরচ(বৈমানিক, প্রশিক্ষক, প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ান)
- পরবর্তী বিমান বা ট্রেনিং এর সাথে সম্পর্ক
- নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের প্রাপ্যতা
- দুটি দেশের মধ্যকার সম্পর্ক
- আর্থিক লেনদেনের বিষয়
- প্রযুক্তি বিনিময় ও প্রস্তুতকারী দেশ/কোম্পানী কতৃক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা;
দক্ষিন কোরিয়া আশির দশকের শেষ দিকে নিজেরাই বিমান বানানোর পরিকল্পনা করে। তাদের নিজেদের তৈরি প্রথম বিমান কেট-১। প্রায় ২৫০০ কেজি ওজন বহনে সক্ষম ( ২ জন বৈমানিক সহ) এ বিমান ,সামনে ৪ ব্লেডের কানাডার বিখ্যাত পিটি-৬এ-৬২ ইঞ্জিন নিয়ে প্রায় ১৩৩৩ কিমি পথ পাড়ি দিতে পারে। একটানা প্রায় ৪ ঘন্টা উড়তে সক্ষম এ বিমানের সর্বোচ্চ ওড়ার সীমা প্রায় ৩৮ হাজার ফিট।
প্রথম দফায় এর ককপিট একেবারেই সাধারন ছিল, ম্যানুয়েল। পরবর্তীতে কোরিয়া এতে যোগ করে গ্লাস ককপিট, মাল্টি ফাংশান ডিসপ্লে, হেডআপ ডিসপ্লে সহ আধুনিক সব ফিচার। কমিউনিকেশান ও সেন্সরেও বেশ আধুনিকায়ন করা হয়। ডিজাইন থেকে আধুনিকায়ন – সবই করা হয়েছে মুলত সুইজারল্যান্ডের পিসি-৭ বিমানকে সামনে রেখে। পিসি-৯ বিমান এসে, পিসি-৭ বিমানকে প্রতিযোগিতায় অনেকটাই স্বাভাবিকভাবে পিছিয়ে দেয়। আমাদের পাশের দেশ মায়ানমারও পিসি-৯ বিমান ব্যবহার করে।
কোরিয়ান প্রযুক্তি বেশ ভালো। আমেরিকান লকহিড মার্টিন তাদের দেশে বিনিয়োগ করার পর,কোরিয়ান এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি হয়েছে আরো সমৃদ্ধ এতে সন্দেহ নেই। বেসিক ট্রেনিং ম্যানুয়েল – বেসিক ফ্ল্যাইং এন্ড ইন্সট্রুমেন্টেশান, ফরমেশান, এরোবেটিক্স এন্ড নেভিগেশান মিশনের জন্য এটি ভালো বিমান বলা চলে। ল্যাটিন অ্যামেরিকার কিছু দেশে রপ্তানীর উদ্দেশ্যে কোরিয়া বেশ উন্নত কিছু প্রযুক্তিও এতে পরবর্তিতে যোগ করে। কেউ চাইলে নাইট ভিশন গগলস, হ্যান্ডস অন থ্রোটল এন্ড স্টিক এতে যোগ করার সুযোগ রয়েছে।
কোরিয়া থেকে আমাদের বিমান বাহিনী এর আগে বড় কোন কেনাকাটা করেনি। যেহেতু বেসিক ট্রেইনার অন্য ধরনের বিমান থেকে বেশী সময় ফ্লাই করে, এর প্রতিনিয়ত বিভিন্ন যংত্রাংশ ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন হয়। একেবারেই আনকোরা ক্যাডেটের হাতে দেয়া হয় বলে,প্রথম প্রেমিকাকে বেশ শক্ত-পোক্ত হতে হয় যাতে প্রেম অনেকদিন টিকে! কোরিয়ান স্প্যায়ার পার্টসের দাম বেশ চড়া। বিভিন্ন দেশের সাথে তাদের চুক্তি গুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চুক্তির ধারা বেশ কঠিনই। কোরিয়ান বিভিন্ন কোম্পানি থেকেই চড়া দামে কিনতে হবে। এমনকি এতে ব্যবহৃত ফ্রান্সের থ্যালাসের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ কিনতে হলেও সেটা কোরিয়া কে জানিয়েই করতে হবে।
অন্যদিকে তুরুস্কের হুরকুস বেশ আধুনিক এবং একেবারে ৪র্থ প্রজন্মের বেসিক ট্রেইনার। এর কিছু চমৎকার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ডিজাইন থেকে আধুনিকায়ন-সবই করা হয়েছে পিসি-২১ কে সামনে রেখে। এর ককপিট ডিজাইন করা হয়েছে আমেরিকান এফ-১৬ এবং এফ-৩৫ বিমানকে আদর্শ ধরে।সম্ভবত একমাত্র সামরিক কাজে ব্যবহৃত বিমান,যেটায় জ্বালানী সাশ্রয়ী উইংলেট রয়েছে! ব্যবহার করা হয়েছে ৫ ব্লেডের শক্তিশালী পিটি৬এ-৬৮টি ইঞ্জিন। ট্যান্ডেম সিটের বিন্যাসে ক্লিয়ার এলিভেটেড ককপিট শেল কন্সেপ্ট ব্যবহার করায়,উভয় সিট থেকে সামনের রানওয়ে/দৃশ্য দেখা বেশ সুবিধাজনক। হুরকুস-বি ভার্শানে ( বিমানবাহিনী সম্ভবত এটা পেতে চাইবে) ব্যবহার করা হয়েছে ব্রিটেনের BAE সিস্টেমসের তৈরি অপটিক্যাল ওয়েবগাইডেড লাইট-হেডআপ ডিসপ্লে। প্রখর সূর্য, রাতের বেলা কিংবা স্বল্পআলোর আবহাওয়ায় এই এভিওনিক ফিচার দারুন কাজের।সমমানের বিমানে LCD ডিসপ্লে থাকলেও এতে আছে AMLCD মাটি ফাংশান ডিসপ্লে। প্রায় ৩৫ বছর নিশ্চিন্তে ব্যবহার করতে পারবেন, এভাবেই এ বিমান ডিজাইন করা।
ন্যাটো বা ইউরোপিয়ান সেইফটি এভিয়েশানের সকল সর্বশেষ নিয়মকানুন মেনেই হুরকুস ডিজাইন করা হয়েছে। সুপার টুক্যানো, চায়নিজ পিটি-৬, এশিয়া ও ল্যাটিন অ্যামেরিকার দেশগুলোর বাজার ধরতে এর ক্রমাগত আধুনিকায়নও করে চলেছে তুরুস্ক। বিশেষ করে কমিউনিকেশান,ইলেকট্রনিক সেন্সরগুলো দারুন!
পার্টস প্রাপ্তির বিষয়ে পাকিস্তানের সাথে যে চুক্তি করা হয়েছে,তা বেশ লাভজনকই ব্যবহারকারী দেশের জন্য। দামও বেশ নাগালে। চাইলে এফিলিয়েটেদড পার্টনার দেশের কাছ থেকেও যংত্রাংশ কেনা যাবে সহজে, তুরুস্কের মাথা ব্যাথা নেই। কিছু কিছু পার্টসের প্রযুক্তি তারা নিজেরাই ব্যবহারকারীকে সরবরাহ করে থাকে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ ইউরোফাইটার টাইফুন কিনবে। সেক্ষেত্রে একেবারেই লেটেস্ট জেনারেশনের হুরকুস কেনাই ভালো সিধান্ত হতে পারে। কোরিয়ান কেটি-১ থেকে এভিওনিক্স যেমন অনেক উন্নত, তেমনি ঘন্টা হিসেবে সার্বিক ব্যয় অনেক কম। অন্যদিকে, কেনা পরবর্তী স্প্যায়ার পার্টস ও প্রযুক্তি শেয়ারের মত বিষয়ের বিবেচনাও আছে।