Jump to content
Please ensure regular participation (posting/engagement) to maintain your account. ×
The Bangladesh Defence Analyst Forum

Leaderboard

Popular Content

Showing content with the highest reputation on 07/31/2021 in all areas

  1. বাংলাদেশ-ভারত–চীন সম্পর্কে মোড় পরিবর্তনের সময় এল কি বাংলাদেশের সামনে আঞ্চলিক রাজনীতির চ্যালেঞ্জটি অনেক বড়। তবে মোকাবিলাযোগ্য। রাজনীতিবিদেরা সেই অসম্ভবের শিল্পকলা জানেন। আলতাফ পারভেজ প্রকাশ: ১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১১:৫১ অ+অ- বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং আজকাল অনেক ভাষ্যকারের কলমেই বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের আলোচনা শুরু হয় ১৯৭৬ সাল থেকে। কিন্তু পূর্ব বাংলার প্রধান রাজনীতিবিদদের অন্তত দুজন একাধিকবার গণচীন সফর করেছেন ১৯৭০ সালের আগেই। আবার বাংলাদেশে তরুণদের একাংশের মধ্যে মাও সে তুংয়ের রাজনৈতিক আদর্শের চর্চার শুরু তারও আগে থেকে। যেকোনো দুটি জনপদের সম্পর্ক অবশ্যই দূতাবাস খোলার চেয়েও বেশি কিছু। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক পরিচয়ের শুরুও ১৯৭৬ সালের জানুয়ারির আগেই। ১৯৬৭ সালে মাওলানা ভাসানীকে দেওয়া মাও সে তুংয়ের ট্রাক্টরটি পারস্পরিক ওই পরিচয়ের প্রতীকীচিহ্ন হয়ে টাঙ্গাইলে এখনো টিকে আছে। বঙ্গবন্ধুর ১৯৫২ সালের চীন সফরের বিস্তারিত বিবরণও বেশ মনোযোগ কেড়েছে সম্প্রতি। এসব সফর কোনো সাধারণ ভ্রমণ ছিল না; বরং দুই জনপদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছিল তাতে। ছয়-সাত দশকের পরিক্রমা শেষে বাংলার সঙ্গে চীনের সেই সম্পর্ক আজ নতুন এক সন্ধিক্ষণে উপস্থিত। সেই তুলনায় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধন অবশ্যই আরও পুরোনো, ঐতিহাসিক ও বহুমাত্রিক। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের প্রায় প্রতি অধ্যায়ে ভারতীয় ছোঁয়া আছে। তার চিরদিনের সাক্ষী হয়ে আছেন খোদ রবীন্দ্রনাথ-নজরুল। কিন্তু এ সম্পর্কের গাঁথুনিতে হঠাৎ কোথাও যেন টান পড়েছে। অচেনা এই কম্পনের উৎস খুঁজতে গিয়ে কেউ পাচ্ছেন আগ্রাসী এক ড্রাগনের ছায়া, কেউ দেখছেন মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছার প্রয়োজনীয় সিঁড়ি। বিজ্ঞাপন প্রচারমাধ্যমের ভুল বার্তা বাংলাদেশ-ভারত-চীন সম্পর্ক নিয়ে ধারাভাষ্যকারদের নাটকীয় লেখালেখি বিশেষ গতি পেয়েছে গত ১৮ আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের বাংলাদেশ সফরে। হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা কেন এলেন, আনুষ্ঠানিক বৈঠকের ছায়ায় অনানুষ্ঠানিক আলাপে কী আদান-প্রদান হলো, তার সামান্যই জানা গেছে। আবার যতটুকু জানা গেল, সেই তুলনায় গল্পগুজব তৈরি হলো শতগুণ বেশি। অথচ আরেকটু পেছনে ফিরে তাকালেই আমরা দেখব ২০১৩ সালে চীন যখন বিআরআই প্রকল্পে সবাইকে আহ্বান করে, ভারত তখনই ঘোষণা করে ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি। অর্থাৎ ঢাকার সামনে ভূরাজনীতির নাটকীয়তা হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার এই সফরের বহু আগেই তৈরি হয়ে আছে। বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জটি আসলে অন্য রকম। চীন-ভারত উভয়ের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। ডলার গুনতে আগ্রহী যেকোনো সরকার এই অবস্থা বদলাতে চাইবে। কিন্তু পত্রিকাগুলো মনোযোগ সরাতে চাইছে অন্যদিকে, যা জনগণকে ভুল বার্তা দেয় এবং সরকারের জন্য মানসিক চাপ বাড়ায়। একতরফা ভালোবাসায় সম্পর্ক গভীরতা পায় না ভারতে যদি এই প্রশ্ন তোলা হয়, নিকট প্রতিবেশী কোন দেশে তাদের প্রভাব এ মুহূর্তে বেশি, নিঃসন্দেহে তাতে এক-দুটি নামের মধ্যেই বাংলাদেশ থাকবে। এখানে রাজনীতির পাশাপাশি সংস্কৃতির পরিসরেও তাদের গর্ব করার মতো প্রভাবের পরিসর আছে। হিন্দির উপস্থিতি আজ শ্রেণিনির্বিশেষে ঘরে ঘরে। বইয়ের দোকানগুলোয় দেশের বই ছাপিয়ে আছে ভারতীয় প্রকাশনা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একাংশ যদি হয় বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ, একমাত্র ভারতীয়দের সঙ্গেই বাংলাদেশিদের সেটা কিছুটা আছে। মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ও সহায়তা সেই যোগাযোগের ভিত্তি হয়ে আছে। স্বর্ণালি সেই ঐতিহ্যে ভারতীয়রা আজ আর পুরো ভরসা রাখতে পারছে না বলেই মনে হয়। দেশটির সংবাদমাধ্যমের সাম্প্রতিক ভাষ্যগুলোয় সেই মনোজাগতিক সংকটের ছাপ মেলে হামেশা। বিজ্ঞাপন সেই তুলনায় চীনের ভাষা-সাহিত্য-মুভির প্রভাব ঢাকায় বিরল। চীনপন্থী দল-উপদল-গণসংগঠন বলে এখন আর স্পষ্ট কিছু নেই এখানে। আমাদের সাহিত্যে কলকাতার মতো ঐতিহাসিক কোনো চীনা ভরকেন্দ্র নেই। ইট-সিমেন্ট-বালু-রডের গাঁথুনি এবং মাওবাদ ছাড়া বেইজিং বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে বিশেষ কিছু দিতে পারেনি এখনো। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও চীন থেকে আমরা ভবিষ্যতে ঠিক কী নিতে পারব, বলা মুশকিল। সঙ্গে রয়েছে জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের তিক্ত স্মৃতি। অথচ এর বিপরীতে তুলনা করা যায় মুক্তিযুদ্ধে আহত-নিহত ভারতীয় যোদ্ধাদের অবদানের কথা, শরণার্থীদের প্রতি আসাম-ত্রিপুরা-পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সহমর্মিতার স্মৃতি। যুদ্ধোত্তর দিনগুলোতেও ভারত অবশ্যই নবীন রাষ্ট্রে বড় ভরসা ছিল। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই সম্পর্ককে ‘রক্তের বন্ধন’ বলে ভুল বলেননি। গত দশকে স্থল ও সমুদ্রসীমানা নিয়ে বোঝাপড়ায় সামান্য অপূর্ণতাসহ অনেকখানি ঝামেলা মেটানো গেছে দুই দেশের মধ্যে। কোভিডের আগ পর্যন্ত ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানিও বেড়েছে কিছু। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে এসব গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। ভারতের ভিসা পাওয়ার ব্যবস্থাপনায়ও বড় ধরনের সংস্কার ঘটেছে। বাংলাদেশিদের বছরে প্রায় ১৫ লাখ সফর হয় ভারতে। ভিসা ব্যবস্থাপনার সংস্কারে লাভবান হয়েছে উভয় পক্ষ। তবে ভারত যে সময় যতটা দিয়েছে, ঢাকার প্রতিদান ছিল বহুগুণ বেশি। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে ভারত যে অগ্রাধিকার পেল, ভারতীয় ভাষ্যকারদের কলমে তার কিন্তু কোনো প্রশংসা পাওয়া গেল না। এর আগে উত্তর-পূর্ব ভারতের অর্থনীতির সহায়তায় নিজের সীমানা দিয়ে স্থল ও নৌপথে সর্বাত্মক যোগাযোগ সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ। একই অঞ্চলের নিরাপত্তাসংকট সামলাতেও ভারতের চাওয়া পূরণ হয়েছে। নয়াদিল্লির বড় প্রত্যাশা ছিল এসব। বন্ধুত্বকে অর্থবহ করতে বাংলাদেশ তা মিটিয়েছে। এভাবে ১৯৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অডিট করলে বাংলাদেশের আন্তরিকতার ছাপই বেশি নজরে পড়ে। কিন্তু ছোট প্রতিবেশীকেই কেন বেশি দিতে হবে? কেন ভুলে যাব, ইতিহাসে কোনো নিবেদনই চিরস্থায়ী নয়। আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে বন্ধুত্ব ও দূরত্বও স্থায়ী কিছু নয়। একতরফা ভালোবাসায় সম্পর্ক গভীরতা পায় না। পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে নির্বাচনকালে বাংলাদেশবিরোধী যেসব কদাকার প্রচারণা চলে, তার ওপর দাঁড়িয়ে বন্ধুত্বকে গভীরতা দেওয়া দুরূহও বটে। এসব রাজনৈতিক প্রচারণা বাংলাভাষীদের মনস্তত্ত্বকে ১৯৪৭ পেরিয়ে সামনে এগোতে দিচ্ছে না। গুজরাল-ডকট্রিন থেকে বহুদূর সরে গেছে সম্পর্কের লক্ষ্মণরেখা। আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পগুলো যে বাংলাদেশের হৃদয়ে কতটা উদ্বেগ তৈরি করেছে, ভারতের হৃদয় তা কতটা বুঝতে চেয়েছে? ‘বাংলাদেশিরা হলো উইপোকার মতো’—এমন অভিধার জন্যও সীমান্তের ওপার থেকে কেউ দুঃখ প্রকাশ করেনি। ধারাবাহিক এসব দূরত্ব ও বন্ধ্যত্বের মধ্যেই চীনের আবির্ভাব। বিজ্ঞাপন চীন দুনিয়াজুড়ে এখন শিষ্য খুঁজছে চীন অনেক ধৈর্য ধরে ধরে ইটের পর ইট গেঁথে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ককে আজকের অবস্থানে এনেছে। একাত্তর থেকে ছিয়াত্তর পর্যন্ত তারা পিছিয়ে পড়েছিল। দুর্দান্ত মনোযোগে তারা সেই দূরত্ব গুছিয়েছে। রাজনৈতিক দল, ভাবাদর্শ, সংগীত, চিত্রকলা, ছাত্রবৃত্তিকে তারা কমই ব্যবহার করেছে বাংলাদেশ জয় করতে। বরং শক্তপোক্ত এক অর্থনৈতিক-সামরিক ভরসা হয়ে ক্রমে তারা বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের গরিমায় সাহায্য করেছে। দক্ষিণবঙ্গের বেকুটিয়ায় নির্মাণাধীন সেতুটিসহ আটটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু বানাতে সহায়তা দিয়ে বেইজিং শুরু থেকে বার্তা দিচ্ছিল তারা নতুন বাংলাদেশের (উন্নয়ন) ক্ষুধা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। চীনের এই বোঝাপড়া নিঃসন্দেহে কলকাতা-গুয়াহাটি-আগরতলা থেকে আসা কবিতা-গান-নাটক-সিনেমাকেন্দ্রিক ভাবাবেগের চেয়ে বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। পদ্মা সেতুর রেললাইন কিংবা কর্ণফুলীর টানেলে যুক্ত হয়ে চীন বাংলাদেশের কাছে বন্ধুত্বের নতুন মানে দিয়েছে। ৩০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের জন্য চীনের অনুদান বিপুল, ঋণ বিপুল এবং অঙ্গীকার আরও বিপুল। বাংলাদেশের হৃদয়েও এখন বদলে যাওয়ার বিপুল ক্ষুধা। ২০১৬ সালের ২৪ বিলিয়ন ডলারের ক্রেডিট লাইন একটা ক্ষুদ্র সূচনামাত্র, যদি আমরা সামনের দিকে তাকাতে শিখি। এমনকি ভারতের ৭ বিলিয়ন ঋণের অঙ্কও না বাড়ারও কারণ নেই। বাংলাদেশে বেইজিংয়ের এই অগ্রযাত্রায় ভারতের আপত্তি নেই। আপত্তির সুযোগও ছিল না। বাংলাদেশে চীনের গড়া প্রতিটি অবকাঠামো থেকে পরোক্ষে ভারতীয় অর্থনীতিও লাভবান। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের অন্যতম সুবিধাভোগী কলকাতার নিউমার্কেট থেকে ভেলোরের হাসপাতালগুলোও। চীনের অবকাঠামোগত অবদান আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের কাছে রাজনৈতিক সহযোগিতার প্রত্যাশা করতে পারে। এটা অস্বাভাবিক নয়। নয়াদিল্লির দিক থেকে বন্ধুত্ব হারানোর কল্পিত উদ্বেগের শুরু হয়তো এখান থেকেই; যে বন্ধুত্ব হয়তো স্থায়ী বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল কিংবা যে বন্ধুত্বকে ভুল করে কেউ আনুগত্য ভেবেছেন। সাম্প্রতিক ভারতীয় ধারাভাষ্যকারদের প্রত্যাশার সোজাসাপ্টা মানে হলো বাংলাদেশ যত ইচ্ছা চীনা অর্থনৈতিক সহায়তা নিক, রাজনৈতিক আধিপত্যে নয়াদিল্লির আবেগের মর্যাদা দিয়ে চলুক এবং চীনের সঙ্গে সামরিক সম্পর্কও এড়িয়ে চলুক। কিন্তু প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে সাবমেরিন কিনে বাংলাদেশে মৃদুভাবে জানিয়েছে, নিরাপত্তা ইস্যুতেও তাকে এখন স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে শিখতে হবে। অন্তত রোহিঙ্গা-অধ্যায়ের পর বাংলাদেশ কীভাবে আর তার সামরিক শক্তি-সামর্থ্য না বাড়িয়ে থাকতে পারে? আবার ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক পরিসরে চীনও ‘পরাশক্তি’ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। অভূতপূর্ব এক আগ্রাসী কূটনীতির মাধ্যমে নিজের অভিলাষের কথা জানাচ্ছে তারা দুনিয়াজুড়ে। বিজ্ঞাপন যেকোনো নেতারই কিছু শিষ্য দরকার হয়। চীন দুনিয়াজুড়ে এখন শিষ্য খুঁজছে। মধ্য আয়ের দেশের চলতি পর্যায় পেরোতে বাংলাদেশের সবল-সুঠাম-উচ্চাকাঙ্ক্ষী চীনকে দরকার আছে কি না সেটা ঢাকার নীতিনির্ধারকদেরই সিদ্ধান্ত নিতে দিতে হবে। এ সত্যে আঁতকে ওঠার কিছু নেই—চীন ভারতের চারপাশে প্রভাববলয় বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশের বিষয়েও তারা নিরাসক্ত নয়। বিশ্বের সব পরাশক্তি অতীতে আধিপত্য কায়েম করেছে। ভারতসহ অন্য যারা ভবিষ্যতে পরাশক্তি হতে চাইবে, তাদেরও এভাবেই চারদিকে ‘বিনিয়োগ’ বাড়িয়ে যেতে হবে। নেতৃত্ব সব সময় দাপট দাবি করে; সঙ্গে উদারতাও। ৯৭ ভাগ বাংলাদেশি পণ্যকে ট্যারিফ ছাড় দিয়ে চীন সর্বশেষ উদারতা দেখাল। এখন হয়তো ঢাকার কিছু দেওয়ার পালা। তারপরও ভারত বাংলাদেশের জন্য এক মুখ্য বিবেচনা বাংলাদেশ নিয়ে চীন-ভারতের আগ্রহকে ঢাকায় ইতিবাচকভাবেই দেখা উচিত এবং সম্ভবত এখনো তা-ই ঘটছে। চীন-ভারত উভয়ের সঙ্গেই বাণিজ্যের আয়তন ক্রমে বাড়ছে। অন্তত সাম্প্রতিক কোনো বছরই কমেনি। তবে সব সময় ভারসাম্য রক্ষা সহজ নয়। হয়তো প্রয়োজনও নেই এবং লাদাখ সংঘাতের পর সেটা দুরূহ বটে। রংপুরের মতো প্রায় প্রান্তিক অঞ্চলে তিস্তাকে উপলক্ষ করে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার পাওয়ার দৃশ্য বলছে, আসন্ন ভূরাজনীতি বাংলাদেশের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা-বিনিয়োগের নতুন তরঙ্গ নিয়ে আসতে পারে। বছরে ২০ লাখ তরুণকে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হলে অর্থনীতিতে যেভাবে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে হবে, তাতে ওই তরঙ্গে নৌকা ভাসানো ছাড়া বিকল্প কী? তবে অসুবিধার দিকও আছে। দেশের জন্য ঋণের ফাঁদ এবং দুর্নীতির সংস্কৃতি জোরদার হতে পারে এতে। দেশি-বিদেশি সম্পদ কীভাবে খরচ হয় বা হওয়া উচিত, এ নিয়ে গণনজরদারির সঠিক ব্যবস্থা গড়া যায়নি আজও। বাড়তি অর্থ মানেই দুর্নীতির বাড়তি শঙ্কা তৈরি করে। ঋণখেলাপি হয়ে পড়া এবং সম্পদ পাচার তথাকথিত উদ্যোক্তাদের যে মজা এনে দিয়েছে, তাতে চীনকে তাঁরা ভবিষ্যৎ-বান্ধব হিসেবে দেখতে পারেন। পাশাপাশি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের মধ্যেও চীনের দুর্নাম কম। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে চীন কখনোই মোটাদাগে হস্তক্ষেপ করেনি। আবার উইঘুরের মুসলমানদের দুর্দশার গল্পগুলো এখনো কাশ্মীর বা আসামের মুসলমানদের মতো মনোযোগ পায়নি; বাবরি মসজিদের মতো তো নয়ই। এ রকম একটা রিপোর্ট-কার্ড আঞ্চলিক সুনাম-দুর্নামে চীনকে এগিয়ে রেখেছে। পক্ষান্তরে নয়াদিল্লির নীতিনির্ধারকেরা কেন আজও বাংলাদেশ সীমান্তে বেসামরিক মানুষের রক্তঝরা বন্ধ করতে পারলেন না, তা দুঃখজনক। বন্ধুত্ব এবং রক্তপাত একদম বিপরীতমুখী। সার্ক না থাকায় সে কথা বলারও জায়গা নেই। সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পরও তিস্তার প্রবাহ নিয়ে চুক্তি না হওয়ায় কী বার্তা পেল বাংলাদেশের মানুষ? ৫৪টি আন্তনদীর দু–চারটির পানি নিয়েও কেন উভয় দেশ সমঝোতা করে উঠতে পারল না গত পাঁচ দশকে, তা বিস্ময়কর। গ্রীষ্মে শুকিয়ে থাকা নদীগুলোর দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশিদের যে বোবা ক্ষোভ হয়, তা বন্ধুত্বের অতীত দিয়ে কত আর মিটমাট করা যায়। এমনকি, ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিতর্কে বাংলাদেশের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশও ঢাকার পক্ষে মেনে নেওয়া শক্ত, বিশেষ করে যখন মেঠো বাস্তবতায় তার সমর্থন দুর্লভ। তারপরও ভারত বাংলাদেশের জন্য এক মুখ্য বিবেচনা। চার হাজার কিলোমিটারের চেয়েও দীর্ঘ সীমান্ত উভয়ের। এ সত্য অগ্রাহ্য করা যায় না। ভবিষ্যতে এ সম্পর্ক আরও বেশি মনোযোগ ও যত্ন দাবি করতে পারে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বিশেষ বন্ধু এখন। আবার যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বড় বাজারও। বড় বিনিয়োগ পেতে গিয়ে বড় বাজার হারানোর ঝুঁকি নেওয়া যায় না। বিজ্ঞাপন চ্যালেঞ্জটি অনেক বড়, তবে মোকাবিলাযোগ্য চীনকে নিয়ে ভাবতে বসে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের সাম্প্রতিক উদীয়মান মৈত্রীও বাংলাদেশ অগ্রাহ্য করতে পারে না। বিশেষ করে যখন তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কে অর্থনৈতিক গভীরতা বেশি নয়। তবে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ফিরে পেতে পাকিস্তানের পুনঃপুন আগ্রহ বাংলাদেশের বাজারমূল্য বাড়াচ্ছে বৈকি। যেকোনো সরকারকে পূর্বাপর ভেবেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আসামে প্রায় ২০ লাখ বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলমান ‘বাংলাদেশি’ পরিচয়ের এক রহস্যময় রাজনীতির করুণ শিকার হয়ে আছে। পশ্চিমবঙ্গেও তথাকথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের রাজনীতি সরব। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্যের চলতি মাত্রার সঙ্গে এসব অনুপ্রবেশের ‘গল্প’ বেমানান হলেও আঞ্চলিক ভূরাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন বিষয় নয় পশ্চিম-উত্তর সীমান্তের এই দুই দৃশ্য। একই রকমভাবে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানও কোনোভাবেই চীনকে অসন্তুষ্ট করে সম্ভব নয়। বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান এখন পর্যন্ত স্বচ্ছ। কোনো রকম ছদ্মযুদ্ধে নেই ঢাকা। কিন্তু আমাদের আরও বহুদূর এগোতে হবে। দুঃখজনক হলো আঞ্চলিক টানাপোড়েনে বাংলাদেশের জন্য এসব শুভ-অশুভ সংকেত নিয়ে কেবল সরকারকে একাকী সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। ‘জাতীয় ইস্যু’তে ‘জাতীয় ঐকমত্য’ চিরদিনই অধরা এ দেশে। স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর এসব নিয়ে ভাবনাচিন্তার প্রকাশ্য কোনো চেষ্টাই নেই। জনগণের তরফেও মতামত প্রকাশের কাঠামো নেই। ভূরাজনীতিতে ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনের এই মুহূর্তে বাংলাদেশের নাগরিকেরা কেবল দর্শকের ভূমিকাতেই থাকছেন আপাতত। ছায়া-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর রেওয়াজ এ দেশে বরাবরই অনুপস্থিত। কোনো দল ভূরাজনীতি নিয়ে ইদানীং কোনো সভা-সেমিনার-বৈঠক করেছে বলে দেখা যায় না। অথচ এ রকম কথাবার্তার মধ্যেই জাতীয় আকাঙ্ক্ষার হদিস মিলত। এ রকম আলোচনায় চীন-ভারতের প্রতিনিধিদের কাছে আমরা রোহিঙ্গা সংকটে তাদের নিষ্ক্রিয়তার ব্যাখ্যা শুনতে পারতাম। তবে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে অভিমান আর স্থবিরতার মূল্য নেই। বাংলাদেশ গভীর সমুদ্রবন্দর বানাতে না দিলেও পাকিস্তান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কায় চীন ইতিমধ্যে সেটা বানিয়েছে এবং বাংলাদেশের ওপর অভিমান করে বসে নেই। বাংলাদেশ একই উপকূলে অন্য দেশকে রাডার সিস্টেম বসাতে দিলেও চীন হয়তো অভিমান করে বসে থাকবে না। ইতিবাচক কূটনীতির ধরনই আজকাল এ রকম। বাংলাদেশকেও একইভাবে চলতি নতুন ঐতিহাসিক মুহূর্তটিকে হাতের মুঠোয় নিতে হবে। এ চ্যালেঞ্জে জনগণকে যতটা সম্পৃক্ত করা যাবে, ততই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হতে পারে। খেয়াল করলে দেখা যায়, মানচিত্রে ঢাকা-নয়াদিল্লি-বেইজিংয়ের মধ্যে রেখা টানলে একটা ত্রিভুজ তৈরি হয়। সেটা বিষমবাহু ত্রিভুজ। এ রকম ত্রিভুজের বাহু, মধ্যমা, কোণ, লম্ব—সবই অসমান। বাহুর দৈর্ঘ্য জানা থাকলেই কেবল বিষমবাহু ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করা যায়। বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জটি তাই অনেক বড়। তবে মোকাবিলাযোগ্য। রাজনীতিবিদেরা সেই অসম্ভবের শিল্পকলা জানেন। আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক
    1 point
This leaderboard is set to Dhaka/GMT+06:00
×
×
  • Create New...